বাঙালির প্রিয় তালের বড়ার রেসিপি কী? কোন দোকানে সুস্বাদু তালের বড়া পাওয়া যায়?

7 minute
Read



Disclaimer This post may contain affiliate links. If you use any of these links to buy something we could earn a commission. We are a reader supported website and we thank you for your patronage.

 " তালগাছ  

 এক পায়ে দাঁড়িয়ে

সব গাছ ছাড়িয়ে

    উঁকি মারে আকাশে.."

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এই কবিতাটি পড়েনি এরকম বাঙালি হয়তো নেই। আর বাঙালির ঘরোয়া মিষ্টির তালিকায় নারকেল নাড়ু, মুড়ির মোয়া, ছাঁচ মিষ্টির সাথে তালের বড়ার নাম শোনেনি বা খায়নি এমন বাঙালিও কিন্তু বিরল প্রজাতি।

আজ আমাদের লেখার মূল চরিত্র এই তালগাছের তাল। তাল এমন একটি ফল যা কিন্তু অন্যান্য জনপ্রিয় ফলের তুলনায় একটু আলাদা। আমরা আম, কাঁঠালের মত রোজ প্রতিদিন তাল কিনে আনি না খাওয়ার জন্য। মূলতঃ বাঙালিদের জীবনে এই তালের জন্যই বছরের একটি দিন আলাদা করে বরাদ্দ থাকে। 

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তালগাছ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত সমুদ্রের ধারের এলাকা গুলির দৈনন্দিন জীবন যাপনের জন্য তালগাছের বহুল ব্যবহার রয়েছে প্রাচীনকাল থেকেই। সাধারণত ভাদ্র মাস নাগাদ এই তাল পাকে। রাতেরবেলা পুরো এলাকায় তখন পাকা তালের গন্ধ ম-ম করে!

আর ভাদ্র মাসেই হয় হিন্দুদের অত্যন্ত জনপ্রিয় উৎসব জন্মাষ্টমী অর্থাৎ শ্রী কৃষ্ণের আবির্ভাব উৎসব। পশ্চিমবঙ্গে খুব ধুমধামের সঙ্গে এই জন্মাষ্টমী পালিত হয় প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই। আর জন্মাষ্টমীর দিন শ্রীকৃষ্ণের ভোগ প্রসাদের অন্যতম উপকরণ হল এই তাল। বিভিন্ন রকমের ফল, মিষ্টি যাই নিবেদন করা হোক না কেন তার সঙ্গে তালের বড়া, তালের লুচি এবং তাল ক্ষীর ভোগ হিসেবে দেওয়া আবশ্যিক। জন্মাষ্টমীর সঙ্গে তালের কি সম্পর্ক তা জানতে আমাদের মতই ছোট থেকেই কৌতুহল হয় অনেকেরই। সাধারণভাবে মনে করা হয়, যেহেতু ফলটি এই সময়তেই পাকে তাই সহজেই কিনতে পাওয়া যায়। তাই নিবেদন করার নিয়ম সৃষ্টি হয়েছে।

এছাড়া আরেকটি পৌরাণিক গল্পও আছে। সেটা বলবো তবে তার আগে শ্রীকৃষ্ণের ফেভারিট এই খাবার কিভাবে বানানো হয় কোথায় কিনতে পাওয়া যায় সেটা আগে দেখে নিই!

আজ থেকে পনেরো-কুড়ি বছর আগেও তালের বড়া শুধুমাত্র বাড়িতেই বানানো হত। যেদিন বানানো হবে তার আগের দিন বিকেল বেলা তাল পাড়িয়ে রাখা হত গাছ থেকে অথবা কিনে আনা হত। জন্মাষ্টমীর দিন দুপুরবেলা পরিবারের মা, কাকিমা, জেঠিমা, ঠাকুমারা পরিষ্কার কাপড় পড়ে বসতেন ঠাকুরঘরে। প্রথমে তালগুলোকে ভালো করে ধুয়ে ওপরের ছোবড়া ছাড়িয়ে আলাদা করে রাখা হত। তারপর বাঁশের বা বেতের ঝুড়িকে উল্টো করে তাতে তালগুলি ঘষে ঘষে কাথ বের করা হত। এই পুরো প্রসেসটাতেই সময় চলে যেত প্রায় দু-তিন ঘন্টা। তারপর শুরু হত সেই কাথের সাথে পরিমাণমতো নারকেল কোড়া, গুড়, সুজি, ময়দা যোগ করে, তাদের ভালো করে মিশিয়ে বড়া বানানো। 

বড়া ভাজা শেষ হলে তৈরি হত তালের লুচি, হলুদ ছাড়া আলুভাজা আর তাল ক্ষীর। সারা বাড়ি তালের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে থাকতো! বর্তমানে গ্রাম বাংলার দিকে এখনও এভাবেই হয়ত বানানো হয় কিন্তু শহুরে ব্যস্ত জীবনে এত সময় নিয়ে তালের বড়া বানানো নিতান্তই অসম্ভব হয়ে উঠছে। এর একটা বড় কারণ হল নিউক্লিয়ার পরিবার। যে কাজ তিন-চার জনে গল্প করতে করতে করে ফেললে সহজ লাগত, এখন একা তা করতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়। তাই কোনও বছর করতে ইচ্ছে হলে করা হয়, নাহলে স্থানীয় মিষ্টির দোকানই ভরসা। 

এই লেখা পড়ে কারুর প্রচন্ড খেতে ইচ্ছে করতেই পারে সুস্বাদু গরম গরম তালের বড়া। তাই সবার জন্য রইলো কলকাতা এবং শহরতলীর কয়েকটি ঠিকানা, যাতে ইচ্ছে হলেই বেড়িয়ে খেয়ে আসতে পারা যায়..

উত্তর কলকাতার শ্যামবাজার ও তার সংলগ্ন অঞ্চলের মিষ্টির দোকানগুলোতে এবং দক্ষিণ কলকাতার রাসবিহারী এভিনিউয়ের কাছে কিছু মিষ্টির দোকানে জন্মাষ্টমীর সময় তালের বড়া পাওয়া যায়। গড়ে এক একটি বড়ার দাম পড়ে ৪-৫ টাকা। তাছাড়া যদি একটু গ্রাম্য স্বাদ পেতে চান তাহলে হাওড়া-বর্ধমান কর্ডলাইনে ট্রেন ধরে চলে আসুন জনাইতে। এখানকার মিষ্টি মনোহরা বিখ্যাত হলেও জন্মাষ্টমীর সময় সুস্বাদু তালের বড়া বিক্রি হয় মিষ্টির দোকানগুলিতে। জনাই না নেমে যদি সেই ট্রেন ধরেই সোজা গিয়ে বর্ধমান নামেন তাহলে সীতাভোগ-মিহিদানার সাথে সাথে শালপাতার বাটিতে পেয়ে যাবেন গরম গরম তালের বড়া!

এখন সবার মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে, জন্মাষ্টমী তো পেরিয়ে গেছে প্রায় তিন মাস হতে চলল। তাহলে আবার পরের বছরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে?! তাদের সবার জন্য রয়েছে আদি ও অকৃত্রিম তালের বড়ার রেসিপি। ভালো কিছু খাওয়ার জন্য একদিন ঠিকই ছুটি নিয়ে নেওয়া যায়!

নীচে রইলো রেসিপি

উপকরণ

ময়দা - এক বাটি (পরিমাণমতো)

সুজি - এক বাটি

অল্প একটু নুন

নারকেল কোরা - এক বাটি

স্বাদ মতো চিনি

গুড়

আর অবশ্যই ঘন তালের কাথ

সাদা তেল

তালের বড়া তৈরির পদ্ধতি

১) সবার প্রথমে তালগুলিকে ছাড়িয়ে কোনও ঝাঁঝরি বা বেতের ঝুড়িতে কাথ বের করুন। মাঝে মাঝে অল্প জল ছিটিয়ে দিলে আরো মসৃণভাবে কাজটি সম্পন্ন করা যায়!

২) একটা বড় পাত্রে পরিমাণ মতো আটা, ময়দা, সুজি, গুড়, চিনি, নুন, নারকেল কোরা, তালের কাথ দিয়ে খুব ভাল করে মাখুন, যাতে মসৃণ ব্যাটার হয়।

৩) মাখা হয়ে গেলে ১০-১৫ মিনিট ঢাকা দিয়ে রেখে দিন।

৪) এবার গ্যাসে কড়াই বসিয়ে সাদা তেল গরম করুন।

৫) এরপর তালের ব্যাটারকে অল্প অল্প পরিমাণ নিয়ে গরম তেলে দিতে থাকুন। আঁচ বেশি বাড়িয়ে রাখবেন না।

৬) সোনালী ব্রাউন রঙের হওয়া পর্যন্ত ভাল করে ভাজুন। তারপর প্লেটে তুলে নিন। সুস্বাদু তালের বড়া আপনার জন্য রেডি!

সবাইকে জন্মাষ্টমী আর তালের বড়া নিয়ে যে পৌরাণিক গল্পটি শোনা যায় সেটি বলবো বলেছিলাম তাই তো? বলা হয় ঘুম ভেঙ্গে কৃষ্ণকে প্রথম দেখার পর নন্দ যে উৎসব করেছিলেন তাতে সবাইকে তালের বড়া খাওয়ানো হয়েছিল। আর কৃষ্ণেরও খুব প্রিয় খাবার ছিল এটি। তাই ৫৬ ভোগের মধ্যে অবশ্যই তালের বিভিন্ন পদ থাকা বাধ্যতামূলক।

 

সবশেষে একটাই কথা বলব, দোকানের কয়েকটি ঠিকানা দিয়ে দিয়েছি ঠিকই কিন্তু একটি দোকানে আজীবনের জন্য পৃথিবীর সেরা তালের বড়া পাওয়া যায়, সেটি হল, মা-ঠাকুমার হেঁশেল।

নাহ এর কোনও বিকল্প নেই.. 

Logged in user's profile picture