দুর্গাপুজো - এক প্রাণের উৎসব
10 minuteRead
দুর্গাপুজো মানে প্যান্ডেল থেকে পুজোর গান। লাইন দিয়ে এগরোল খাওয়া থেকে ঢাকের তাল। সন্ধ্যারতি থেকে বিজয়ার প্রণাম - এ শুধু পুজো নয়, আমাদের প্রাণের উৎসব।
বছরের প্রথমে ক্যালেন্ডার হাতে পেলে শুরুতেই অক্টোবর মাসের দিকে যাদের চোখ চলে যায়, তারা বাঙালী। দশমীর দিন থেকেই পরের বছর পুজো কবে শুরু হচ্ছে যারা খুঁজতে শুরু করে, তারা বাঙালী। কথাতেই আছে 'বাঙালীর বারো মাসে তেরো পার্বণ'। আর তার মধ্যে দুর্গাপুজো হল তাদের উৎসব, মিলনের উৎসব।
বাংলায় ঠিক যখন থেকে বর্ষা কেটে গিয়ে শরতের নীল আকাশ উঁকি দেয়, ঠিক তখন থেকেই পুজো শুরু হয়ে যায় বাঙালীর। দুর্গাপুজো মানে শুধু চারদিন নয়, যে মুহূর্তে প্যান্ডেলে বাঁশ খাটানো শুরু হয় আমাদের মনে বেজে ওঠে পুজোর ঢাক। যদি প্রশ্ন করা হয় দুর্গাপুজো মানে কী কী বোঝায়, তার উত্তরে বলা যায়:
মহালয়া
পুজো শপিং
কোলকাতার পুজো
গ্রামের পুজো
প্যান্ডেলে ঘোরার প্ল্যান
পুজোয় খাওয়া দাওয়া
পূজাবার্ষিকী এবং পুজোর গান
আসছে বছর আবার হবে!
মহালয়া
সিডনি থেকে সিউড়ি, নিউ ইয়র্ক থেকে নিউ আলিপুর - পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তে থাকা বাঙালী এইদিন রেডিও বা ইউটিউবে একটাই অনুষ্ঠান শোনে প্রতি বছর, যার নাম 'মহিষাসুরমর্দিনী'। সেই নব্বই বছর ধরে সমস্ত বাঙালী পুজো শুরুর প্রায় এক সপ্তাহ আগে ভোর সাড়ে চারটেয় ঘুম থেকে উঠে শোনে এই অনুষ্ঠান। দুর্গাপুজো শুরুর আনুষ্ঠানিক সূচনা এই মহালয়ার দিনটাই। বাকি পাঁচ-ছ'দিন চলে কেনাকাটার শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতি।
Durga Pujo without Pujo shopping? No way!
পুজো শপিং
সারা বছরের শপিং একদিকে। আর পুজোর শপিং পুরো অন্যদিকে! পুজোর শপিং মানে তো শুধু কেনাকাটা নয়, একটা উত্তেজনা। পুরো হাতিবাগান বা নিউ মার্কেট ঘুরে ঘুরে, প্রচুর দোকানে ঢুকে দাম নিয়ে দরাদরি করে নতুন জামা, জুতো, জুয়েলারি কেনার মজা যারা পায়নি তারা হতভাগ্য মানুষ! আর এ সময় পুরো পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে দোকানপাট সেজে ওঠে ঝলমলে রঙীন পোষাকের সম্ভার নিয়ে, সাথে চলে 'পুজোর সেল'। সকাল থেকে ঘুরে ঘুরে জিনিস কিনে দুপুরে ভালো করে পেটপুজো সেরে আমরা বাড়ি ফিরে আসি।
ষষ্ঠী থেকে দশমী এই পাঁচদিনের নতুন ড্রেস থেকে জুয়েলারির কয়েকটি স্বর্ণখনির নাম জানতে চান? আপনার জন্য রইলো কিছু নাম:
দক্ষিণাপণ
নিউ মার্কেট
গড়িয়াহাট
বড়বাজার
হাতিবাগান
কোয়েস্ট মল
কোলকাতার পুজো
দেখতে দেখতে এসে যায় পুজোর দিনগুলো। আমাদের শহর সেজে ওঠে রাণীর সাজে। ক্লাবে ক্লাবে থিম পুজোর লড়াই, রাস্তা জুড়ে আলোর মালা, মানুষের ভিড়, রঙীন বেলুন, মাইকে ভেসে আসা পুজোর মন্ত্র- সব মিলিয়ে দুর্গাপুজোয় কোলকাতা হয়ে ওঠে পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর শহর। লাইন দিয়ে রাত জেগে ঠাকুর দেখা, পা ব্যাথা হলে কারুর বাড়ির রোয়াকে বসে জোর আড্ডা দেওয়া। তারপর অষ্টমীর দিন নতুন শাড়ি এবং পাঞ্জাবি পড়ে অঞ্জলী দেওয়া- এর কোনও তুলনা নেই। তাই যারা প্রবাসী তাঁরা সবাই চান ফিরে আসতে এ সময় নিজের জায়গাতে। ফিরতে না পারলে এই পাঁচদিন মনখারাপ থাকবেই তাঁদের মনে। কারণ দুর্গাপুজো মানেই তো homecoming. মা-ও তো বাড়িই আসেন তাঁর।
গ্রামের পুজো
যারা শহরের ভিড়ভাট্টা পছন্দ করেন না, পুজোয় তাদের জন্য রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামের প্রাচীন পুজো। তার কোনওটা প্রায় ৫০০-৬০০ বছর আগের জমিদার বাড়ির পুজো, যাকে বনেদী বাড়ির পুজো বলা হয়। আবার কোনওটা বারোয়ারী পূজা কমিটির পুজো। গ্রামের খোলা নীল আকাশ, কাশফুল আর শিউলির গন্ধমাখা পরিবেশে একবার পুজো কাটালে মন প্রতিবছর যেতে চাইবে সেখানেই। এ পুজোতে থাকে বেশিরভাগই সাবেকী একচালার প্রতিমা, যাঁকে দেখলে এমনিই দু'হাত জড়ো হয়ে প্রণাম করতে ইচ্ছে করে।
কিরকম পুজো আপনার পছন্দ? তবে যাদের পছন্দ ষষ্ঠীতে সাউথ আর সপ্তমীতে নর্থ, তাদের জন্যই নিচের পয়েন্টটা..
প্যান্ডেলে ঘোরার প্ল্যান
প্যান্ডেল ঘোরা মানে কি শুধুই ঠাকুর দেখা? একদমই নয়। দুর্গাপুজোয় শুধুমাত্র মন্ডপসজ্জাতে জড়িত থাকেন বহু নামী শিল্পীরা (সনাতন দিন্দা অন্যতম)। প্রায় এক বছর ধরে বিখ্যাত ক্লাবগুলি পুজো মন্ডপের পরিকল্পনা করেন, যাকে 'থিম পুজো' বলা হয়। থিমের মধ্যে যেমন থাকে ভারতের অন্য রাজ্য, বিখ্যাত স্থাপত্য। তেমনই কোনও বিশেষ জিনিস (যেমন: বাঁশ, বেত, কাঁচ) দিয়ে সাজানো মন্ডপ। মন্ডপের থিমের সাথে মিলিয়ে বাজানো হয় আবহসঙ্গীত, থাকে সাবেকী ঝাড়বাতি থেকে আলোর খেলা। এখন প্রতিমা গঠনেও থাকছে সেই থিমের ছোঁয়া।
সুতরাং অবশ্যই কোলকাতার 'সেরা পুজো'দের দেখার জন্য প্ল্যান বানাতেই হয়। থিমপুজো এবং সাবেকীপুজো দুটোকেই কিন্তু কভার করতে হবে সেই প্ল্যানে।
কোলকাতার কয়েকটি বিখ্যাত পুজোর লিস্ট দিলাম নীচে:
বাগবাজার সার্বজনীন
শোভাবাজার রাজবাড়ি
কুমোরটুলি পার্ক
কলেজ স্কোয়ার
মহম্মদ আলি পার্ক
সন্তোষ মিত্র স্কোয়্যার
বাদামতলা আষাঢ় সংঘ
সুরুচি সংঘ
দেশপ্রিয় পার্ক
একডালিয়া এভারগ্রীন
নাকতলা উদয়ন সংঘ
পুজোয় খাওয়া-দাওয়া
আমরা বাঙালী ভাই, খাবার ছাড়া আমাদের উৎসব পালন হয় না। আর পুজোয় খাওয়ার জন্য তো আলাদা একটা মেনুই তৈরী থাকে আমাদের। কী কী থাকে সেই মেনুতে?
গরম ভাত, মাছের মাথা দিয়ে সোনামুগের ডাল, পাঁচ রকম ভাজা, গলদা চিংড়ির মালাইকারী, সর্ষে পাবদা, কষা মাংস, গরম গরম লুচি, চালের পায়েস, মিষ্টি দই, রসগোল্লা….
আরো অনেক কিছু বাদ থেকে গেল কিন্তু, যা যা থাকবে মেনুতে! তাছাড়া এগুলো সবই মেইন কোর্স, ঠাকুর দেখতে দেখতে পায়ের সাথে মুখ চলবে না তা কি হয়! সুতরাং ফুচকা, এগরোল, চাউমিন, ফিশফ্রাই, কাবাব, মোমো, ধোসা, আইসক্রীম- এই সবকিছুই স্ন্যাকস হিসেবে খাওয়া হয়।
পেট যতই ভরা থাক রাস্তার ফুডস্টল থেকে আসা গন্ধে মন ঠিক খাই-খাই করে উঠবেই..
কয়েকটি বিখ্যাত রেস্টুরেন্টের নাম নীচে রইলো:
৬ বালিগঞ্জ প্লেস
আমিনিয়া
গোলবাড়ি
সপ্তপদী
আহেলী
কষে কষা
আওয়াদ ১৫৯০
দ্য স্কুপ
পূজাবার্ষিকী ও পুজোর গান
বাঙালীর বইপ্রীতি সবার জানা। কোলকাতার কলেজ স্ট্রীট বাংলার গর্ব। সুতরাং তাদের প্রধান উৎসবে বই জড়িয়ে থাকবে না তা কি হতে পারে?
সারাবছরই প্রচুর ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয় এখানে। পুজোর সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করে পূজাবার্ষিকী। এই ট্র্যাডিশন কিন্তু আজকের নয়, প্রায় ১০৮ বছর ধরে দুর্গাপুজো এবং পূজাবার্ষিকী সমার্থক শব্দ হয়ে গেছে। ঠিক তেমনই পুজোর গানও। বিগত কয়েক বছর ধরে যদিও নতুন গানের এলবাম নিয়ে মাতামাতি আর হয় না, তবে এক সময়ের বেশির ভাগ বিখ্যাত গানই কিন্তু পুজোর সময় প্রকাশিত হত।
পুজোর দিনের অলস দুপুর, মাইকে বাজছে পুজোর গান, হাতে রয়েছে পূজাবার্ষিকী - ঘরে ঘরে এই দৃশ্য দেখা যেত দশ বছর আগেও। তবে হারিয়ে যায় নি এখনও, আশা রাখি কখনও যাবেনা..
"আসছে বছর আবার হবে.."
মা দুর্গা আমাদের কাছে ঘরের মেয়ে। যিনি প্রতিবছর তাঁর সন্তানদের নিয়ে আসেন বাপের বাড়ি। চারদিন পরে আবার ফিরে যান কৈলাসে! তাই এই চারদিন আমরা মায়ের পুজো করে মা'কে শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা জানাই, তেমনই নিজেরা খুব আনন্দ করি যাতে মা খুশি থাকেন।
মহাষষ্ঠীর বোধনে যে আনন্দের সূচনা হয় তাতে দশমীর সকালে ঘট বিসর্জনের পর দুঃখ এসে মেশে। তবে এই আনন্দের উৎসব কি মনখারাপে শেষ হয়? একদমই নয়। আমরা মা দুর্গা, তাঁর চার সন্তান সাথে মহিষাসুরকেও মিষ্টিমুখ করিয়ে বিদায় জানাই। আর চিৎকার করে বলে উঠি, "আসছে বছর আবার হবে!"
বিসর্জনের ঢাক বেজে ওঠে তারপর..
তাহলে বাংলায় দুর্গাপুজো মানে কী দাঁড়ালো?
এখানকার আকাশ থেকে মাঠ, গ্রাম থেকে শহর, নদীর পার থেকে লালদিঘী, কাঁচামাটির রাস্তা থেকে রাজপথ- সবাই সেজে ওঠে যে পুজোতে, সব বয়সী মানুষের মুখে খুশির আভা ছড়িয়ে থাকে যে পুজোতে, বেলা বারোটায় ওঠা মেয়েটা ঢাকের আওয়াজে ভোর ছ'টায় উঠে পড়ে যে পুজোতে, সব ধর্মের আর সব জাতির মানুষ শুভ বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময় করেন যে পুজোতে...
তাকে দুর্গাপুজো বলে..
বাংলা এবং বাঙালীকে জানতে চাইলে, বুঝতে চাইলে একবার পুজো কাটাতেই হয় এখানে। ভালোবেসে ফেলবেন এ রাজ্যকে। তাই তো দুর্গাপুজো আমাদের প্রাণের উৎসব।
Write, Record and Answer! Consume Unlimited Content! All you need to do is sign in and its absolutely free!
Continue with one click!!By signing up, you agree to our Terms and Conditions and Privacy Policy.